গর্ভধারণের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়কে ফারটাইল উইন্ডো বলে। ফারটাইল উইন্ডো হল আপনার মাসিক চক্রের সেই সময় যা আপনি গর্ভবতী হওয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনা বেশি। বেশিরভাগ মানুষের জন্য, এটি ডিম্বস্ফোটনের আগের পাঁচ দিন, ডিম্বস্ফোটনের দিন এবং ডিম্বস্ফোটনের পরের দিন। আপনার মাসিক ফারটাইল উইন্ডো গণনা করা আপনাকে গর্ভধারণের জন্য সহবাসের আদর্শ সময়টি লক্ষ্য করতে সহায়তা করতে পারে।
এই লেখায় গর্ভবতী হওয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময় নির্ণয় করার পদ্ধতিগুলো এবং মাসিকের কতদিন পর সহবাস করলে সন্তান হয় — তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ফারটাইল উইন্ডো
আপনার মাসিক সাইকেল বোঝা
যদি আপনি গর্ভবতী হওয়ার চেষ্টা করেন এবং ডিম্বস্ফোটন ট্র্যাক করতে চান, তাহলে আপনাকে আপনার মাসিকের সাইকেল বা চক্র সম্পর্কে বুঝতে হবে। আপনার মাসিক চক্র হল গর্ভাবস্থার জন্য আপনার শরীরের প্রস্তুতি নেওয়ার উপায়। এটি আপনার মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় এবং আপনার পরবর্তী মাসিক শুরু হবার আগের দিন পর্যন্ত কে বলে।
ধরুন আপনার মাসিক শুরু হয়েছে ২ তারিখ, তারপর আবার সেই মাসের ২৯ তারিখ মাসিক হলো। তাহলে আপনার ২ তারিখ হতে মাসিকের সাইকেল শুরু, ২৮ তারিখ শেষ। ২৯ তারিখ আবার নতুন সাইকেল শুরু হবে। তাহলে আপনার মাসিকের সাইকেল ছিলো ২৭ দিনের।
একটি সাধারণ মাসিক চক্র ২৮ দিনের, তবে ২১ থেকে ৩৫ দিনের চক্রগুলি স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়।
চক্রের সময় আপনার শরীরে অনেক পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে হরমোনের ওঠানামা অন্তর্ভুক্ত। প্রায় চক্রের মাঝামাঝি সময়ে, আপনার একটি ডিম্বাশয় একটি পরিপক্ক ডিম ছেড়ে দেয়। ডিমটি আপনার ফ্যালোপিয়ান টিউবগুলির একটিতে যায়, যেখানে এটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। আপনার জরায়ুর আস্তরণও পুরু হয়ে যায়। এটি নিষিক্ত ডিমের স্থাপনের জন্য জরায়ুকে প্রস্তুত করে।
যদি আপনি গর্ভবতী না হন, তবে এটি বোঝায় যে ডিমটি নিষিক্ত হয়নি বা ভ্রূণ (নিষিক্ত ডিম) জরায়ুতে স্থাপন হয়নি। সেই ক্ষেত্রে, জরায়ুর আস্তরণ ঝরে পড়ে এবং আপনি আপনার মাসিক পেতে পারেন।
আমি কখন ডিম্বস্ফোটন করছি?
আপনার ফারটাইল উইন্ডো ট্র্যাক করতে এবং গর্ভবতী হওয়ার সেরা সময় নির্ধারণ করতে ডিম্বস্ফোটন কখন হচ্ছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভধারণের সম্ভাবনাময় বা ফারটাইল উইন্ডো চেনার অনেক পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলিকে রিদম পদ্ধতিও বলা হয়।
১) সাদা স্রাব বা সার্ভিক্যাল মিউকাসের মাধ্যমে গর্ভধারণের সঠিক সময় জানা
এই পদ্ধতি কাদের জন্য
আপনার মাসিক নিয়মিত বা অনিয়মিত যেমনি হক সবসময় এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে যাদের মাসিক অনিয়মিত তাদের জন্য এই পদ্ধতি খুব উপযুগি। কারণ অন্যান পদ্ধতিতে তাদের গর্ভধারণের সম্ভাবনাময় বা ফারটাইল উইন্ডো বের করা কঠিন।
সাদা স্রাব বা সার্ভিক্যাল মিউকাসের পদ্ধতি
প্রতিমাসে মেয়েদের সাদা স্রাব দুই থেকে চার রকমের অবস্থা লক্ষ করা যায়।
১) প্রথম অবস্থা হলো মাসিকের ঠিক পরে যখন কোনো সাদা স্রাব দেখা যায় না। মাসিকের রাস্তা শুকনা মনে হয়। তখন গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুব কম বা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকে ( ০.৩%)।
২) দ্বিতীয় অবস্থায় হলো যখন মাসেকের রাস্তা হালকা ভেজা মনে হয়। কিন্তু চোখে কোনো সাদা স্রাব দেখা যায় না এবং হাত দিয়েও ধরতে পারেন না। তখন গর্ভধারণের সম্ভাবনা ১% এর একটু বেশি থাকে (১.৩%)।
যাদের মাসিকের সাইকেল বা চক্র খুব ছোট, তাদের ক্ষেত্রে প্রথম দুইটি অবস্থা দেখা নাও যেতে পারে। মাসিকের সাথে এই দুইটি হতে পারে।
তবে তৃত্বীয় ও চতুর্থ অবস্থা সবার ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়।
৩) তৃত্বীয় অবস্থায় হলো যখন ঘণ সাদাস্রাব যায়। সাদা স্রাব হাতে আঠালো হয়ে লেগে থাকে। সেই সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা আগের তুলনাই বেড়ে ২.৫% হয়।
৪) চতুর্থ বা শেষ অবস্থায় হলো যখন সাদাস্রাব বা সার্ভিক্যাল মিউকাস দেখতে স্বচ্ছ, খুব পাতলা ও পিচ্ছিল হয়। এর ধারাবাহিকতা কাঁচা ডিমের সাদা অংশের মতো পিচ্ছিল ও মসৃণ হয়। সেই সময় সাদাস্রাব দুই আঙ্গুল দিয়ে টেনে কয়েক ইঞ্চি বড় করলেও ভাঙ্গে না। এই সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে প্রায় ৩০% এর কাছাকাছি থাকে।
এই পদ্ধতি কীভাবে কাজে লাগাবেন?
যেদিন থেকে সাদাস্রাব দেখতে পাবেন সেই দিন থেকে শুরু করে শেষ যেদিন পাতলা, পিচ্ছিল সার্ভিক্যাল মিউকাস হবে তারপরের ৩ দিন পর্যন্ত বাচ্চা নিবার জন্য চেষ্টা করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
২) স্ট্যান্ডার্ড ডে পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করার উপায়
এই পদ্ধতি কাদের জন্য
স্ট্যান্ডার্ড ডে পদ্ধতি নির্দিষ্ট দিনগুলিতে সহবাস এড়িয়ে গর্ভধারণ প্রতিরোধ বা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিটি সাধারণত যাদের মাসিক সাইকেল ২৬ দিনের কম হয় না এবং ৩২ দিনের বেশি হয় না তাদরে জন্য কার্যকর। যদি আপনার মাসিক সাইকেল অনিয়মিত হয়, তবে এই পদ্ধতি আপনার জন্য কার্যকর নাও হতে পারে।
স্ট্যান্ডার্ড ডে পদ্ধতি
আপনার মাসিকের প্রথম দিনটি চিহ্নিত করুন এবং সেই দিনটিকে ১ দিন হিসেবে গণনা করুন। এই পদ্ধতি মাসিকের ৮ দিন থেকে ১৯ দিন পর্যন্ত আপনার ফারটাইল উইন্ডো বা গর্ভধারণের সম্ভাবনার সময়কালে সবচেয়ে বেশি থাকে।
মাসিক সাইকেল কীভাবে হিসাব করবেন?
যেদিন থেকে আপনার মাসিক শুরু হবে সেই দিন বা তারিখ ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখবে। মাসিক শেষ হবার দিন দাগ দিবার দরকার নেই। আবার পরের বার যখন মাসিক শুরু হবে তখন আবার দাগ দিবেন। প্রথম মাসিকের দাগ দেওয়া আর দ্বিতীয় মাসিকের দাগ দিবার মধ্যে যে কয়েক দিনের পার্থক্য থাকবে , তাই হবে আপনার মাসিকের দৈঘ্য বা সাইকেল।
এই পদ্ধতি কীভাবে কাজে লাগাবেন?
শুধু মাত্র এই পদ্ধতি ব্যবহার না করে উপরের সব পদ্ধতি মিলিয়ে ব্যবহার করুন। কারণ সবসময় যে আপনার ৮-১৯ দিনের মধ্যেই ডিম্বস্ফোটন হবে এমন না।
৩) ক্যালেন্ডার পদ্ধতি গর্ভধারণ করার উপায়
ক্যালেন্ডার পদ্ধতি একটু কঠিন হলেও খুব ভালো কাছে দেয়। উপরে আমরা মাসিক সাইকেল হিসাব কীভাবে করবেন তা দেখিয়েছি। এই নিয়মে আপনাকে ছয় মাস পর্যন্ত হিসাব করতে হবে। এই ছয় মাসে আপনি ছয় থেকে সাতটি মাসিক সাইকেলের দৈর্ঘ্য পাবেন। সবগুলোর দৈর্ঘ্য এক নাও হতে পারে। ৬টি সাইকেল পাবার পরে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ছোট সাইকেল নিতে হবে।
সবচেয়ে ছোট সাইকেল থেকে ১৮ বিয়োগ করলে যে সংখ্যা পাবেন, আপনার মাসিকের সাইকেলের সেই দিন থেকে ফারটাইল উইন্ডো শুরু। আর সবচেয়ে বড় সাইকেলের থেকে ১১ বিয়োগ করলে যে সংখ্যা পাবেন, সেই দিন থেকে আপনার সাইকেলের ফারটাইল উইন্ডোর শেষ দিন।
আরও পড়ুন
ধরা যাক, আপনার মাসিকের সবচেয়ে ছোট সাইকেল এর দৈর্ঘ্য ২৫ দিনের। এখান থেকে ১৮ বিয়োগ করলে ৭ হয়। অর্থাৎ আপনার সাইকেলের ৭ দিন থেকে ফারটাইল উইন্ডো শুরু। এবার ধরা যাক, আপনার সবচেয়ে বড় মাসিক সাইকেলের দৈর্ঘ্য ৩২ দিন। এখান থেকে ১১ বিয়োগ করলে ২১ হয়। অর্থাৎ আপনার সাইকেলের ফারটাইল উইন্ডো শেষ হবে ২১তম দিনে।
তাহলে আপনার মাসিক শুরু হবার ৭ দিন থেকে ২১ দিন পর্যন্ত আপনার ফারটাইল উইন্ডো বা গর্ভধারণের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়। এর যে কোনো একদিন ডিম্বস্ফোটনের সম্ভবনা আছে।
গর্ভধারণের জন্য কীভাবে সহবাস করতে হবে?
গর্ভধারণের সেরা সম্ভাবনার সময়ের জন্য, আপনাকে ডিম্বস্ফোটনের বা ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হবার:
- আগের পাঁচ দিন
- ডিম্বস্ফোটনের দিন
- ডিম্বস্ফোটনের পরের দিন
এই সময়গুলিতে প্রতিদিন বা প্রতি এক দিন অন্তর সহবাস করতে হবে।