ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। বেশিরভাগ মানুষের জন্য, ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে জ্বর হলে সেটা ডেঙ্গু কি-না তা আগে ভাগে সনাক্ত করা গেলে এর ভয়াবহতা অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।

ডেঙ্গু জ্বর, যা “ব্রেকবোন ফিভার” নামেও পরিচিত, একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে উচ্চ জ্বর এবং শরীরে ব্যথা অন্তর্ভুক্ত। গুরুতর ডেঙ্গু শকের পাশাপাশি হেমোরেজিক ফিভারও সৃষ্টি করতে পারে, যা জীবন-সংকটময় হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

এই আর্টিকেলে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, কারণ এবং কারা ঝুঁকির মধ্যে আছে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত প্রায় ৭৫%1 মানুষের মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কখন দেখা দেয়?

ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর ৩-১৪ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। সাধারণ সর্দিজ্বর বা পেট খারাপের মতো লক্ষণ দেখা দেয়। হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর আসতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ১০৪°F হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো কী কী?

যদি লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে প্রায় ১০৪°F (৪০°C) 2 হঠাৎ জ্বর হতে পারে এবং এর সাথে নিম্নলিখিত এক বা একাধিক লক্ষণ থাকতে পারে:

  • পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা
  • র‍্যাশ বা চামড়ায় ফুসকুড়ি
  • চোখের পেছনে ব্যথা
  • বমি বমি ভাব এবং বমি
  • মুখমণ্ডল লাল হয়ে যাওয়া
  • গলা ব্যথা
  • মাথাব্যথা
  • চোখ লাল হওয়া

গুরুতর লক্ষণসমূহ

ডেঙ্গু জ্বরের প্রায় ০.৫% থেকে ৫%3 ক্ষেত্রে গুরুতর অবস্থায় পরিণত হয়। যদি এমন হয়, তাহলে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সাধারণত, প্রথমে জ্বর ৯৯.৫°F থেকে ১০০.৪°F (৩৭.৫°C থেকে ৩৮°C) পর্যন্ত কমে যায়। এরপর ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বা অসুস্থতা শুরু হওয়ার ৩–৭ দিনের মধ্যে গুরুতর লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • পেটে ব্যথা বা কোমলতা
  • ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত তিনবার বমি হওয়া
  • নাক বা মাড়ি থেকে রক্তপাত
  • বমির সাথে রক্ত আসা
  • মলের সাথে রক্ত থাকা
  • অবসন্নতা
  • অস্থিরতা বা বিরক্তি বোধ
  • শরীরের তাপমাত্রা অত্যন্ত গরম থেকে অত্যন্ত ঠান্ডায় পরিবর্তন 4 
  • ঠান্ডা, ভেজা ত্বক
  • দুর্বল এবং দ্রুতগতির নাড়ির স্পন্দন
  • সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়া

যে কারো মধ্যে গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু মশা

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কতদিন থাকে?

লক্ষণগুলো সাধারণত ২–৭ 5 দিন স্থায়ী হয় এবং বেশিরভাগ মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো বোধ করে। জ্বর বেড়ে যেতে পারে, ২৪ ঘণ্টার জন্য কমে যেতে পারে, তারপর আবার বেড়ে যেতে পারে।

ডেঙ্গু শনাক্ত করার পরীক্ষা

ডেঙ্গু শনাক্ত করতে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত, রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি বা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে শরীরের তৈরি করা অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো নিম্নরূপ:

  • এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট: ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রথম দিকে এই টেস্টটি করা হয়, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  • আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট: এই টেস্টগুলোর মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের তৈরি করা অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা হয়। আইজিএম অ্যান্টিবডি সাধারণত সংক্রমণের প্রথম দিকে তৈরি হয়, আর আইজিজি অ্যান্টিবডি সংক্রমণের পরে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে।
  • পিসিআর (PCR) টেস্ট: এই টেস্টটি ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ডেঙ্গু শনাক্ত করার একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
  • সম্পূর্ণ রক্তের সংখ্যা (CBC) টেস্ট: এই টেস্টের মাধ্যমে রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা এবং অন্যান্য উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা ডেঙ্গু রোগীর অবস্থার মূল্যায়নে সাহায্য করে।

এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত করা হয় এবং রোগীর চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

ডেঙ্গুর ঘরোয়া চিকিৎসা

ডেঙ্গুর চিকিৎসা লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে। হালকা ধরনের ডেঙ্গুর চিকিৎসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • পানিশূন্যতা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
  • প্রচুর বিশ্রাম নেওয়া
  • ব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা, যা জ্বর কমাতেও সাহায্য করতে পারে

ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি জাতীয় ওষুধ যেমন অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলো অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ

চারটি ভাইরাস ডেঙ্গু জ্বরের কারণ হতে পারে। এই ভাইরাসগুলো এডিস ইজিপ্টি মশা বা, খুবই কম ক্ষেত্রে, এডিস এলবোপিক্টাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়।

একটি ভাইরাসবাহিত মশা কাউকে কামড়ালে তা মানবদেহে প্রবেশ করে। যখন আরেকটি মশা সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেটি ভাইরাসটি নিয়ে যায়। এরপর সেই মশা যাকে কামড়াবে, তার মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেবে। একজন ব্যক্তি একাধিকবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে, তারা যে নির্দিষ্ট ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ইমিউন হয়ে যাবেন। কিন্তু অন্য তিনটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউন হবেন না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এগুলো হলো:

  • মশা কামড় থেকে রক্ষা: মশার প্রতিষেধক ব্যবহার করুন, যেমন মশার স্প্রে বা ক্রিম। বাইরে যাওয়ার সময় লম্বা হাতা এবং প্যান্ট পরুন।
  • মশার প্রজনন ক্ষেত্র কমানো: মশা ডিম দেয় এমন স্থানগুলো পরিষ্কার রাখুন। মশার প্রজনন ক্ষেত্র হলো জল জমে থাকা স্থান, যেমন পানির ট্যাঙ্ক, ফুলের টব, এবং অন্যান্য ছোট পাত্র।
  • জল জমে থাকা স্থান পরিষ্কার করা: ঘর এবং আশেপাশের পরিবেশে জল জমে থাকা স্থানগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করুন। বৃষ্টির জল জমে থাকলে তা দ্রুত সরিয়ে ফেলুন।
  • মশার টোপ ব্যবহার: মশার ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের টোপ বা জালের ব্যবহার করতে পারেন, যা ঘর ও বাড়ির চারপাশে মশা ধরতে সাহায্য করে।
  • স্বাস্থ্যবান জীবনযাপন: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সঠিক পুষ্টি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
  • বিশেষ সতর্কতা: ডেঙ্গু প্রবণ এলাকায় ভ্রমণের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং মশা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে ডেঙ্গু জ্বরের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

সারাংশ

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ হলো মশার মাধ্যমে ছড়ানো একটি ভাইরাস। বেশিরভাগ মানুষই এর লক্ষণ অনুভব করেন না। তবে, যদি লক্ষণ প্রকাশ পায়, তা সাধারণত মৃদু হয়। কিছু ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু জ্বর জীবন-সংহারী হতে পারে।

লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, ব্যথা, এবং ত্বকে র‍্যাশ। যারা গুরুতর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, তাদের ক্ষেত্রে ক্রমাগত বমি হওয়া, মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। গুরুতর ডেঙ্গু হলে অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন।

সাধারণ প্রশ্ন

১. ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে?

সাধারণত কোনো জটিলতা না থাকলে ২-৭ দিন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এর বেশি সময়ও থাকতে পারে।

২. ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে?

পানিশূন্যতা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। প্রচুর বিশ্রাম নিন এবং ব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করুন।

৩. ডেঙ্গু জ্বর কি ছোঁয়াচে রোগ?

না, ডেঙ্গু জ্বর ছোঁয়াচে নয়। এটি ছড়ায় এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে। যখন এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায় এবং তারপর সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

৪. ডেঙ্গু জ্বর হলে কি গোসল করা যাবে?

ডেঙ্গু জ্বর হলে গোসল করা যাবে, তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ডেঙ্গু জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা বেশি হতে পারে এবং দুর্বলতা থাকতে পারে, তাই হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা ভালো। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে শরীরের তাপমাত্রা আরও কমে যেতে পারে, যা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, গোসলের সময় খুব বেশি পরিশ্রম না করা এবং যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। তবে শরীরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং হালকা গোসল নেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

তথ্যসূত্র:

  1. Symptoms of Dengue and Testing 2024
    https://www.cdc.gov/dengue/signs-symptoms/ ↩︎
  2. Dengue Fever 2024
    Timothy J. Schaefer; Prasan K. Panda; Robert W. Wolford.
    https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK430732/
    ↩︎
  3. Dengue Fever 2024
    Timothy J. Schaefer; Prasan K. Panda; Robert W. Wolford.
    https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK430732/ ↩︎
  4. Dengue and severe dengue 2024
    https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/dengue-and-severe-dengue ↩︎
  5. Manage Dengue 2024
    https://www.cdc.gov/dengue/treatment/ ↩︎

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *